সূত্র - জাগোনিউজ, 19 Aug 2018 যেভাবে প্রতিবন্ধকতা জয় করছেন কানিজ ফাতেমা কানিজ ফাতেমা ন-তে ‘নারী’, ন-তে ‘না’। নারীকে থামিয়ে রাখা যাবে না। আর তাই তো কখনো মাঠে নেমে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কখনো বা অফিসে বসে মানুষের কষ্ট লাঘবে দিন-রাত সমানতালে কাজ করে যাওয়া। ‘নারী এখন আর ঘরের বোঝা নয়’- কথাটি প্রমাণেই নারীরা এগিয়ে চলেছে অদম্য গতিতে। তেমনই একজন অদম্য নারী কানিজ ফাতেমা। ২৯তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ সফল এ নারী কর্মকর্তাকে নিয়ে লিখেছেন রিফাত কান্তি সেন- দেশের সব সেক্টরেই নারীদের এখন জয়জয়কার। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধীদলীয় নেত্রী এমনকি দেশের বৃহত্তর সেক্টরগুলোতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ যাকে নিয়ে কথা: যে শিশু ১৯৮৫ সালে নওগা জেলার পত্নীতলার নজিপুর গ্রামে আবদুল করিম ও সেলিনা বেগম দম্পতির ঘর আলোকিত করেন; তিনিই বর্তমান কানিজ ফাতেমা। দুই ভাই-তিন বোনের সংসারে হাসি-ঠাট্টা আর আনন্দ নিয়েই বেড়ে উঠেছেন তিনি। দুরন্তপনা আর ঘোরাঘুরিতে কেটেছে তার বেলা। পাশাপাশি পড়ালেখার প্রতিও ছিল প্রচণ্ড টান। গ্রামের পরিবেশেই কেটেছে বাল্যকাল। শিক্ষা জীবন: শিক্ষা জীবনে প্রথম হাতেখড়ি হয় নওগার নজিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এরপর মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন পিএস সরকারি গার্লস হাইস্কুল থেকে। উচ্চমাধ্যমিকে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে পাস করেন। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি হন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। সেখান থেকে ২০০৬ সালে অনার্স এবং ২০০৭ সালে মাস্টার্স পাস করেন। শৈশবের স্মৃতি: দুরন্তপনায় ঘেরা শৈশব দিনগুলো কাটিয়েছেন খুবই আনন্দে। নিজের মুখেই বললেন, ‘আজকাল শিক্ষার্থীদের এ-প্লাসের জন্য নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে সারা দিন-রাত শুধু বইয়ের বোঝাই টেনে যেতে হয়; আমাদের সময় এমন ছিল না। পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা। দুরন্তপনা করেও আমি ভালো ফলাফল করতে পেরেছি। তবে মজার একটি ঘটনা হলো- প্রাথমিকে আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম। আমি যে বৃত্তি পেয়েছি, আম্মা এটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি কয়েকবার খবরাখবর নিয়ে নিশ্চিত হলেন যে, আসলেই আমি বৃত্তি পেয়েছি।’ কর্মজীবন: ২০০৭ সালে অনার্স পাস করেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের ‘ইয়াং প্রফেশনাল’ পদে যোগদান করেন। এরপর ঢাকা স্টক একচেঞ্জে চাকরি করেন। ২০১০ সালে ২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ২০১১ সালের ১ আগস্ট গাইবান্ধা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ‘সহকারী কমিশনার’ হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে ‘সহকারী কমিশনার’ হিসেবে ফেনী জেলায়, একই বছরের শেষের দিকে সোনাগাজী উপজেলায় যোগদান করেন। ২০১৫ সালের ৬ জুলাই চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণে ‘সহকারী কমিশনার (ভূমি)’ হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৬ সালে ‘সিনিয়র সহকারী কমিশনার’ হিসেবে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এবং ২০১৭ সালের জুন মাসে ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা’ হিসেবে চাঁদপুর সদরে যোগদান করে নিজের কর্মস্পৃহাকে বাড়িয়ে তোলেন। প্রতিবন্ধকতা: নারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতাই মোকাবেলা করতে হয়। বিশেষ করে প্রভাবশালীদের তদবির কাজের ক্ষেত্রে বেশ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কর্ম এলাকার বাল্যবিবাহগুলো ঠেকাতে গিয়ে রাজনীতিবিদদের চাপ সামলাতে হয়। এরপরও সবকিছু উপেক্ষা করে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। অনুপ্রেরণা: মা এবং স্বামী- দু’জনের দিক থেকেই খুব বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার বইগুলো পড়ে মনে হলো- নারী হয়েছি যেহেতু; সেহেতু নিজেকে বদলে দিতে হবে। এমন কিছু করতে হবে, যেন সাধারণ মানুষের খুব কাছে পৌঁছতে পারি। আমার পরিবারের বেশিরভাগই শিক্ষক ছিলেন। তখন আমিও ভাবতাম শিক্ষক হবো। কিন্তু পরে মনে হলো- শিক্ষক নয়; বিসিএস দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থেকে সেবার হাত বাড়িয়ে দেবো।’ অর্জন: জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়ে থাকলেও শ্রেষ্ঠ অর্জন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ২০১৭ সালে ‘জনপ্রশাসন পদক’ লাভ করা। এ প্রসঙ্গে কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘সে মুহূর্তটি কখনোই ভোলার মত নয়। চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আব্দুস সবুর মণ্ডল স্যারের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পদক লাভ করতে পারাটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন হিসেবে গ্রহণ করতে চাইছি।’ বাল্যবিবাহ রোধ: সমাজের একটি মারাত্মক ব্যধি বাল্যবিবাহ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, অভিভাবকরা সচেতন হলেই বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব। পারিবারিক কিছু ঘটক আছেন, যারা কিনা অভিভাবকদের ভুল বুঝিয়ে নারীর ইচ্ছাকে অমর্যাদা করছে। আমি ১৮ বছরের নিচের নারীদের বলতে চাই, তোমরাই পারো বাল্যবিবাহ রোধ করতে।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। এলাকার প্রভাবশালী মহল বিষয়টিতে সাহায্য করে। মেয়েরা যদি সচেতন হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তবে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব।’ নারীর ক্ষমতায়ন: নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কালো অধ্যায় শুরু হয়। এরপর পুরুষের ক্ষমতায়ন আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। বর্তমানে বেশ ক’বছর ধরেই বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী, আমার বর্তমান কর্মস্থলের এমপি মহোদয় নারী। সুতরাং বলা চলে সারা দেশে এখন নারীর জয়জয়কার।’