alexa

Carrer tips

Rizia Parvin,

চাকরি, সংসার ও একজন মা

চাকরি, সংসার ও একজন মা
Working Mother

একজন মা হয়ে সংসার ও চাকরির মধ্যে সমন্বয় তৈরি করা মোটেও সহজ কোন ব্যাপার না। আর তা যদি হয় ঢাকার মত শহরে তবে কাজটা হয়ে যায় দ্বিগুণ কষ্টসাধ্য। তবে তথ্য প্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে সঠিক উপায়ে কাজ করলে অসম্ভব কিছুই নেই। বাংলাদেশে সফল চাকরিজীবী মায়ের উদাহরণ রয়েছে অগণিত। ঢাকার রাস্তায় পা রাখলেই তার নমুনা চোখে পরবে প্রতিনিয়ত।

তারা কি কৌশল অবলম্বন করেন? কি করলে আপনিও হতে পারেন সফল চাকরিজীবী মা?

মানসিক প্রস্তুতিঃ

নিজেকে দোষী ভাববেন না

চাকরি করার কারণে বাচ্চাদের সময় দিতে পারছেন না বলে অনেক মা নিজেকে দোষী ভাবেন। আবার পরিবারকে সময় দিতে গেলে ভাবেন তিনি অফিসের দায়িত্ব পালন করছেন না। এই ভাবনা তাদের কর্ম ও পারিবারিক উভয় জীবনকে অপূর্ণ করে তোলে। কোন কাজই তখন সঠিকভাবে হয় না। উভয় কাজে নিজের সর্বোচ্চটা দিতে হলে দুটাকেই গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে ও নিজের দায়িত্ব মনে করতে হবে। চাকরিটা আপনি আপনার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই করছেন।

“আমাকে দিয়ে হবে না” এই ধরণের ভাবনা দূর করুন

সংসার একটা জটিল প্রতিষ্ঠান। আপনি যদি একটা সংসার নামক প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সফল হয়ে থাকেন তবে একটা চাকরি সঠিকভাবে চালিয়ে যাওয়া আপনার কাছে পানি-ভাত। শুধু আপনাকে নিজের সময়কে সঠিক ভাবে কাজে লাগানোটা শিখতে হবে।

কে কি বলছে তাতে কান দিবেন না

আমাদের সমাজ যদিও অনেক আধুনিক হয়ে গেছে তারপরেও সমালোচনা করার মত লোকের অভাব নেই। আপনার গঠনমূলক কাজের ভুলত্রুটি খুঁজে বের করার ও ভিত্তিহীন গুজব ঝরানোর অনেক লোক আপনি খুঁজে পাবেন। আপনার আত্মীয় স্বজনের মধ্যেই এদের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। এসবে কান দিবেন না। মনে রাখবেন এদের কেউই আপনার বিপদে এগিয়ে আসবে না। আপনার বিপদ আপনাকেই সামলাতে হবে।

বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার ক্ষমতা তৈরি করুন

আমাদের দেশে পরিবারের মেয়ে সদস্যদের বাস্তবতার অভিজ্ঞতা কম থাকে। এরা বেড়ে ওঠে বাবা, মা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে। বাইরের মানুষের সাথে চলাফেরার অভিজ্ঞতার সুযোগ না থাকায় বাস্তবতা তাদের কাছে অচেনা থাকে। যে কারণে চাকরির ক্ষেত্রে যাবার পর একজন অনাত্মীয় ও অপরিচিত মানুষের আন্তরিকতাহীন ব্যবহার তারা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেন না। ফলে চাকরির আগ্রহ ধীরে ধীরে কমে যায়। মনে রাখতে হবে সবাই আপনার বন্ধু বা আত্মীয় না, সবার থেকে আপনি ভাল ব্যবহার প্রত্যাশা করলে আপনি ভুল করবেন। তাই বাজে ব্যবহারের জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।

শারীরিক প্রস্তুতিঃ

মহিলাদের মধ্যে নিজের শরীরের প্রতি যত্ন না নেয়ার, অসুস্থ হলেও ডাক্তার না দেখানোর একটা বাজে প্রবণতা আছে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাকরির বাজারে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে শারীরিক ভাবে আপনাকে হতে হবে সর্বদা প্রস্তুত। এজন্য নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রাখার কোন বিকল্প নেই। যখন তখন অসুস্থ হয়ে পরলে চাকরির বাজারে আপনি টিকে থাকতে পারবেন না।

কর্মস্থল নির্বাচনঃ

আপনি কতটা কার্যকারিতার সাথে চাকরি করতে পারবেন এবং চাকরিতে টিকে থাকতে পারবেন কিনা সেটা অনেকাংশে নির্ভর করে কর্মস্থল নির্বাচনের উপরে।

বাসা ও অফিসের দূরত্ব মাথায় রাখুন

বাসা ও অফিস নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপনাকে খুবই সতর্ক হতে হবে। বাসা যদি অফিস থেকে বেশি দূরে হয় এবং আপনার যদি নিজের গাড়ি না থাকে তাহলে আপনি হয়তো বিশাল বিপদে পরবেন। ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম ভয়াবহ রকমের খারাপ তাই গণপরিবহনের উপর নির্ভর করে পুরুষ যাত্রীদের সাথে পাল্লা দিয়ে অফিসে যাওয়াটা রীতিমত যুদ্ধের সমান। তাই অফিস ও বাসা পায়ে হাঁটার দূরত্বের মধ্যে হলে ভাল। যাতে অতিরিক্ত জ্যাম থাকলে হেটেই চলে যাওয়া যায়। আপনি যদি ভেবে থাকেন আপনি গণপরিবহন ব্যবহার করবেন না, রিকশা বা সিএনজি ব্যবহার করবেন সেটাও হয়তো খুব ভাল সিদ্ধান্ত হবে না কারণ তাতে আপনার বেতনের অনেকাংশ যাতায়াতেই নষ্ট হয়ে যাবে। বাসা ও অফিস কাছাকাছি হলে প্রচুর সময়ও সাশ্রয় করা যায়। দূরত্ব বেশি হলে অনেক সময় ২ থেকে ৪ ঘণ্টা আপনাকে রাস্তায় কাটাতে হতে পারে। যেহেতু বাসায় আপনার বাচ্চা থাকবে তাই অফিস কাছাকাছি হলে যেকোনো জরুরী প্রয়োজনে আপনি দ্রুত বাসায় চলে যেতে পারবেন। অফিসের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা থাকলে আপনার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ।

চাকরির সেক্টর নির্বাচন

নতুন করে কিছু শেখার ঝামেলা না নেয়াই ভাল। আপনি যে কাজে অভ্যস্ত বা পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে সে ধরণের কাজেই যাওয়ার চেষ্টা করুন। এতে করে আপনার কাজ আরো সহজ হয়ে যাবে। আপনি দ্রুততার সাথে কাজ শেষ করতে পারবেন ও অবশিষ্ট সময় সংসারে দিতে পারবেন। বাংলাদেশের মত সামাজিক পরিবেশে মায়েদের জন্য সম্পূর্ণ ডেস্ক-জব বেশি সুবিধাজনক। আউটডুর জব নির্বাচন করলে আপনাকে কিছু বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। অফিসের কাজ বাসায় নিয়ে যেতে হয় এমন চাকরি থেকে দূরে থাকা সুবিধাজনক।

কোম্পানি সম্পর্কে জানুন

যেহেতু আমাদের দেশে নারীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক না তাই কোম্পানি নির্বাচনে সতর্ক হওয়া জরুরী। কোম্পানির পরিচিতি, কার্যক্রম, ব্যবসা, পরিচালনা কমিটি, সহকর্মীদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন।

পারিবারিক করনীয়ঃ

স্বামীর সাথে কাজ ভাগ করে নিন

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ঘরের কাজ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমান ভাগে ভাগাভাগি করে নেয়া। নিজেদের সুবিধা মত রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সংসার ও সন্তান সংক্রান্ত সকল কাজ বন্টন করে নিতে হবে। সংসারের সব কাজ নিজে করে আবার চাকরিও ঠিক রাখা কারো পক্ষে সম্ভব না। পারস্পারিক সহযোগিতা থাকলে চাকরি ও সংসার সামলানো খুবই সহজ হয়ে যায়।

অফিসের জিনিসপত্র সব সময় একটা নির্দিষ্ট স্থানে রাখুন

কাজের ব্যস্ততায় অনেকেই অফিসের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাসায় ফেলে যান। এর সব চাইতে সহজ সমাধান হল ঘরের দরজার আশেপাশে একটা নির্ধারিত জায়গা ঠিক করা যেখানে আপনি ঘরের চাবি সহ অফিসের প্রয়োজনীয় সব কিছু একসাথে রাখবেন। সেখানে একটি চেকলিস্ট লাগিয়ে রাখতে পারেন, বের হবার আগে পড়ে দেখবেন যে সব কিছু নেয়া হয়েছে কি না।

বাচ্চাদের স্কুল ও কোচিং নির্বাচনঃ

বাচ্চাদের স্কুল ও কোচিং নিজের অফিসের পথে ফেলার চেষ্টা করুন। এবং স্কুল ও কোচিং এর সময়সূচী অফিসের সময়সূচীর সাথে মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করুন।

বাচ্চাদেরকে নিজের কাজ নিজে করতে শেখানঃ

একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে বাচ্চাদেরকে তাদের নিজের কাজ নিজে করতে শেখান। এতে তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ বাড়বে, দক্ষতা বাড়বে পাশাপাশি আপনার সময় বাঁচবে। একাধিক বাচ্চা থাকলে তাদের সবার জন্য একটা রুটিন তৈরি করে দিন। খাওয়া, গোসল, পড়াশুনা, ঘুম ও অন্যান্য কাজ যেন সবাই একই সময়ে করে। তাতে আপনার সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।

কাউকে সর্বক্ষণের জন্য বাসায় রাখুন

সম্ভব হলে প্রাপ্তবয়স্ক কাউকে সব সময়ের জন্য বাসায় রাখুন। বেশি ছোট বাচ্চা হলে এটির কোন বিকল্প নেই। যাকে রাখবেন সে আত্মীয় যেমন মা বা শাশুড়ি হলে ভাল। অনাত্মীয় কেউ আপনার বাচ্চার যথেষ্ট খেয়াল নাও রাখতে পারেন।

অবসরে বাসায় যোগাযোগ করুন

যেহেতু আপনি বাসায় থাকছেন না তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাসায় ফোন বা ভিডিও কল করে বাচ্চাদের সাথে কথা বলা অত্যন্ত জরুরী। এতে করে বাচ্চাদের সাথে আপনার সম্পর্ক মজবুত হবে।

ফ্যামিলি ক্যালেন্ডার তৈরি করুন

মোবাইলে একটা ক্যালেন্ডার তৈরি করুন। যেখানে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল দেয়ার তারিখ; বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার তারিখ, বাচ্চাদের জন্মদিন বা অন্যান্য ইভেন্টের এলার্ম দিয়ে রাখবেন। ঘরের যাবতীয় কাজের জন্যই আপনি এলার্ম দিয়ে রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনি গুগল ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে পারেন।

লম্বা সময় নষ্ট করে এমন বিনোদন ত্যাগ করুন

যেহেতু আপনাকে অফিসে সারাদিন ব্যয় করতে হয় তাই দিন শেষে বাড়ি ফেরার পর পরিবারের জন্য সময় বরাদ্দ রাখুন। টিভি সিরিয়াল দেখা, ফেসবুকে অযথা ঘোরাফেরা করার মত সময় নষ্ট করা অভ্যাস ত্যাগ করে সে সময়টাতে কোন একটা কাজ করুন অথবা বাচ্চাদের সাথে কাটান।

ছুটি গুলোকে কাজে লাগান

ছুটির দিনে কি কি কাজ করবেন সেটা আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ না থাকলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যান। এতে বাচ্চাদের ও পরিবারের অন্যদের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়।

স্বামীর সাথে সময় কাটান

বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানো যেমন জরুরী স্বামীর সাথে সময় কাটানোও জরুরী। কেননা পরিবারটা তৈরি হয়েছে মূলত আপনাদের দুজনের মাধ্যমে। আপনাদের মধ্যে কোন প্রকার দূরত্ব সৃষ্টি হলে তার প্রভাব স্বাভাবিক ভাবেই বাচ্চাদের ও পুরো পরিবারের উপর পরবে।

অফিসে করনীয়ঃ

ছুটি বাঁচিয়ে রাখুন

অযথা ছুটি নিয়ে ছুটি নষ্ট করবেন না। যেহেতু আপনি একটা সংসার সামলাচ্ছেন, হঠাৎ করেই আপনার লম্বা সময়ের জন্য ছুটি নেয়া জরুরী হতে পারে। তাই ছুটি হাতে রাখুন যেন চাইলেই পাওয়া যায়।

যোগাযোগ বজায় রাখুন

অফিসে সকল পর্যায়ের লোকের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রাখুন। এতে আপনার কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। পুরুষ শাসিত সমাজে একজন নারী কর্মীকে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে পরতে হয় তাই অফিসে সহকর্মীদের সহায়তা ছাড়া স্বাভাবিক ভাবে কাজ করা প্রায় অসম্ভব।

নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার

আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের দেশের নারীরা বরাবরই দুর্বল। প্রযুক্তি আপনার কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবনকে অনেক সহজ করে দিতে পারে। তাই কাজের ক্ষেত্রে সব সময় নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে উদার হতে হবে। যেমন ধরুন আপনি চাইলেই আইপি ক্যামেরার মাধ্যমে অফিসে বসে আপনার বাচ্চাদের উপর নজর রাখতে পারেন।

নির্ধারিত সময় অফিস ত্যাগ করুন

আপনাকে কেউ মনে করিয়ে দিবে না যে কখন আপনার বাচ্চাকে স্কুল থেকে বাসায় নিতে হবে বা কখন তাদের জন্য নাস্তা তৈরি করতে হবে। তাই অফিস থেকে বের হওয়ার একটা নির্দিষ্ট সময় নির্বাচন করুন। প্রতিদিন ঠিক একই সময় অফিস ত্যাগ করুন। আপনার বস ও সহকর্মীরা যেন বিষয়টার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায় আর আপনাকে ওই সময় উটকো কোন কাজ ধরিয়ে না দেয়।

নিজের অধিকার বুঝে নিতে নিন

মেয়েরা অনেক সময় নিজের অধিকার বুঝে নেয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহী হন। একটা কর্পোরেট অফিসে কেউ আপনাকে যেচে এসে আপনার অধিকার বুঝিয়ে দেবে না। আপনার অধিকার আপনাকেই বুঝে নিতে হবে।

মাতৃকালীন ছুটি

আপনি যদি ভবিষ্যতে বাচ্চা নেয়ার চিন্তা করে থাকেন তবে অফিসের মাতৃকালীন ছুটির নীতিমালা সম্পর্কে ভাল করে জানুন। সেই ছুটির সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে আপনার পরিকল্পনা তৈরি করুন।

প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দিন

একজন মায়ের কাছে পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তার সন্তান। অনেকের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যে কোন ভাইবেই চাকরি ঠিক রেখে সন্তানদের যত্ন নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে যদি আপনার অর্থনৈতিক বিশেষ অসুবিধা না হয় তবে চাকরি ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবা উচিৎ। আপনি নতুন চাকরি খুঁজে নিতে পারবেন কিন্তু আপনার সন্তানের কোন ক্ষতি কোন ভাবেই পূরণ করা সম্ভব না।